তখন আমি স্কুলে পড়ি। খুব ছোট। আব্বু আম্মু দুজনই বাইরে। আমি আর আমার ছোট বোন ফুফুর সাথে বিছানায় রাতে শুয়ে আছি।
হঠাত কান্নার আওয়াজে ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। বুঝতে পারলাম যে ফুফু আমাদের দুইজনকে জরিয়ে ধরে বিছানাতে শুয়েই কান্না করছে।
গভীর রাত। এর মধ্যে বিলাপ-মিশ্রিত কান্নার আওয়াজটা খুব সুক্ষ ভাবে দেয়াল ভেদ করে এলাকায় ছড়িয়ে যাচ্ছিল।
পুরান ঢাকায় থাকতাম তখন। ওদিকে বাসাগুলো অনেক বড় হতো এবং অনেকগুলো কামরা থাকতো। পুরোনো মডেলের সেই বিশাল বাড়িতে তিনটি পরিবার থাকতাম প্রতিবেশির মতো। ফুফুর কান্নার শব্দ পেয়ে কেয়া আপুর আম্মু আমরা যেই রুমে শুয়ে ছিলাম সেই রুমের জানালায় এসে আস্তে আস্তে ফুফুকে জিজ্ঞেস করলো “হাসপাতাল থেকে খবর আসছে?”
প্রশ্ন শুনেও ফুফু তার কান্না দু সেকেন্ডের জন্য থামিয়ে জবাব দেয়ার প্রয়োজন বোধ করলো না। উত্তর আমারও জানা ছিল না। তাছাড়া ফুফুকে সান্ত্বনা দিবো ততটুকু বোধ সেই বয়সে হয়নি। বোকার মতো নিশ্চুপ হয়ে রইলাম কতক্ষণ মনে নেই। আন্টি জবাব না পেয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চলে গেলো।
একটু পর বাইরে থেকে আম্মুর কান্না জর্জরিত কন্ঠ শুনতে পেলাম। আব্বু আম্মুর সাথে আরো আত্মীয় প্রতিবেশি ঘরে প্রবেশ করলো। সেই গভীর রাতের অন্ধকারেই দাদীর মৃতদেহ নিয়ে এ্যাম্বুলেন্সে করে সপরিবার রওনা দিলাম গ্রামের বাড়িতে।
আমার গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জ আর সেটি ছিল ১৫ই আগস্টের প্রথম প্রহরের রাত। সম্ভবত ড্রাইভারের পাশের সিটে সিদ্দিক ভাইয়ের কোলে বসে যাচ্ছিলাম। ফ্রন্ট সিটে বসে ঢাকা থেকে গোপালগঞ্জের পথে রাস্তার এপার-ওপাড় পর্যন্ত বিস্তীর্ণ মোট কয়শো শোক দিবসের ব্যানার দেখেছি বলতে পারবো না।
প্রথম কয়েকটাতে বড় করে শোক দিবস লেখা দেখে মনে মনে ভাবছিলাম দাদীর মৃত্যুর খবর এরা কিভাবে জানলো? পদ্মার এপাড় ফেরিতে উঠার সিরিয়ালে যখন আমাদের এ্যাম্বুলেন্সটা দাঁড়ালো তখন একটা ব্যানার পুরোটা পড়ার সুযোগ হয়েছিল। এর আগে স্কুলের কোনো পাঠ্যবইয়ে এই বিষয়ে পড়েছিলাম কিনা জানি না, কিন্তু সেদিনই প্রথম জাতীয় শোক দিবসের সাথে পরিচয় হলো।
হঠাত মনে হলো দাদীর জন্যও কি দেশে একটা শোক দিবস হবে? হলেও দাদীর ছবি কি দিবো? দাদীর তো আলাদা কোনো ছবি নাই, শুধু আমার সাথে কয়েকটা ছবি আছে। ওগুলো দিবো?
আসলে এর আগে আমি এত কাছ থেকে নিজের পরিবারে কারো মৃত্যু দেখি নাই। তাই মৃত্যুর গুরত্বটা তখনও আমার মস্তিস্কে বাসা বাঁধতে পারেনি। একারনেই দুনিয়ার সব রকমের চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল।
তাছাড়া আমি আম্মু আর দাদীর কাছে সমান ভাবেই বড় হয়েছি। রাতে ঘুমাতাম দাদীর কাছেই। দাদীর পাকা চুল তুলে দিতাম। আব্বুর কাছ থেকে টাকা নিয়ে উনার পান কিনে দিতাম। এর বদলে ঘুমানোর সময় উনি প্রতিরাতে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতো। আব্বু আম্মুর কাছে বকা খেলে, আমাকে মারতে এলে দাদীই বাধা দিতো।
এরকম কাছের একটা মানুষ এত দূরে চলে যাবে সেটা তখনও উপলব্ধি করতে পারি নাই। উপলব্ধিটা এসেছিল অনেকদিন পর।
পদ্মা নদী পার হয়ে ওপারে যখন এ্যাম্বুলেন্স চলতে শুরু করে তখন ভোর হয়ে গেছে। এই ভোরের মৃদু রোদেই পদ্মার ওপাড় থেকে গোপালগঞ্জ পর্যন্ত কতগুলো শোক সভাই না দেখেছি। মাইকে চিৎকার করে আর্তনাদের সহিত বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিচারণ আর এ্যাম্বুলেন্সের কান ফাটানো সাইরেন সেই শোকের ভোরকে ধারালো চাকুর মতো কেটেই যাচ্ছিল। গোপালগঞ্জের সরু রাস্তার উপর আছড়ে পড়া শব্দবানের আওয়াজে একটা সময় এ্যাম্বুলেন্সের ভিতরে বসে থাকা মানুষের কান্নার আওয়াজটা পর্যন্ত আমার কান পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছিল না।
প্রতিবছর এদিন এলেই এই স্মৃতিটাই আমার মনে পড়ে। ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস হিসেবে এদেশের সবার কাছেই পরিচিত। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর স্মরণে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত হয় এই শোক। তবে রাষ্ট্রীয় শোকের সাথে আমার ব্যক্তিগত শোক কেমন যেন মিলে একাকার হয়ে গেছে। এখন বঙ্গবন্ধুর নাম শুনলেই আমার জীবনের প্রিয় ঐ মানুষটার কথা মনে পড়ে।
Pingback: August 2022 – Do I Overshare? – Rifat Ahmed