যদি বলি এক ব্যাটারি দিয়ে আপনার ডিভাইস চলবে ২৮,০০০ বছর, বিশ্বাস হবে? হয়তো হবে না।
কিভাবেই বা হবে, আমরা তো প্রতিদিন ঘুমানোর আগে ফোন চার্জ দিয়ে অভ্যস্ত।
যেখানে আমাদের স্মার্টফোনের ব্যাটারি টানা দুইদিন চার্জ ধরে রাখতে অক্ষম সেখানে বিনা চার্জে আটাশ হাজার বছর একটানা একটি ডিভাইসের চলা অবাস্তব মনে হতেই পারে। কিন্তু এই অসম্ভবই সম্ভব হচ্ছে বেটাভল্টেয়িক্সের (Betavoltaics) কারনে যার মূলে আছে নিউক্লিয়ার বর্জ্যের তেজস্ক্রিয়তা।
নিউক্লিয়ার বর্জ্য রিসাইক্লিং নিয়ে বিজ্ঞানীরা চিন্তিত সেই আশি-নব্বইয়ের দশক থেকেই। আর এই বর্জ্য রিসাইক্লিং করার প্রচেষ্টাতেই বেটাভল্টেয়িক্সের সূচনা।
বেটাভল্টেয়িক ব্যাটারির মূলনীতি খুবই সরল। এই ব্যাটারি বা ডিভাইসের কাজ বেটা পার্টিকেল (β Particle) ব্যবহার করে তড়িৎ প্রবাহ উৎপন্ন করা। বেটা পার্টিকেল আর কিছুই নয়, শ্রেফ উচ্চ শক্তি সম্পন্ন ইলেক্ট্রন। বেটাভল্টেয়িক ব্যাটারিতে একটি সেমিকন্ডাটরের পাশে বেটা বিচ্ছুরণকারী (উচ্চ শক্তি সম্পন্ন ইলেকট্রন) পদার্থ স্থাপনের মাধ্যমেই তড়িৎ প্রবাহ উৎপন্ন করা হয় যে প্রবাহ কয়েক হাজার বছর পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। ব্যাটারির এই দীর্ঘ স্থায়িত্বকালের পিছনে আছে তেজস্ক্রিয় পদার্থের ‘স্লো রেডিওএক্টিভ ডিকে’।
তেজস্ক্রিয় পরমাণুর অর্ধায়ু অনেক বছরের আর এই ধীর শক্তি ক্ষয়ের কারনেই বেটাভল্টেয়িক ব্যাটারিগুলো নিরবিচ্ছিন্ন তড়িৎ উৎপন্ন করতে পারে বছরের পর বছর।
অনেকেই হয়তো বেটাভল্টেয়িক্সকে রেডিওআইসোটোপ থার্মোইলেকট্রিক জেনারেটর বা RTG এর সাথে গুলয়ে ফেলতে পারেন যা নাসা তাদের স্পেস মিশনগুলোর জন্য ব্যবহার করে আসছিল কয়েক দশক ধরে। কিন্তু আরটিজিগুলো সঞ্চালিত হয় তেজস্ক্রিয় পদার্থ (যেমন প্লুটোনিয়াম) থেকে নির্গত তাপ থেকে যেখানে বায়োভল্টেয়িক্স বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে সরাসরি বেটা পার্টিকেল ব্যবহার করে যা আরটিজি থেকে কয়েকগুন বেশি এফিশিয়েন্ট।
বেটাভল্টেয়িক ব্যাটারিগুলো আরটিজি বা নিউক্লিয়ার ব্যাটারি থেকে আকারে অনেক ছোটো এবং এর তেজক্রিয়তা অনেকাংশেই কম। তাছাড়াও বেটাবভল্টেয়িক ব্যাটারি স্থায়িত্বকাল আরটিজি থেকে কয়েকগুন বেশি। এসব বিবেচনা করলে বেটাভল্টেয়িক ব্যাটারি যে প্রচলিত নিউক্লিয়ার ব্যাটারি থেকে প্রায় সবদিক থেকেই এগিয়ে সেটা খুব স্পষ্টভাবেই অনুধাবন যায়।
পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে অনেকগুলো গবেষকদল বেটাভল্টেয়িক ব্যাটারির বিভিন্ন মডেল ও ফাংশনাল ভেরিয়েশন নিয়ে কাজ করছে। এর মধ্যে সবচেয়ে কার্যকর হলো রেডিওএক্টিভ ডায়মন্ড ব্যাটারি যা অনেকের কাছে নিউক্লিয়ার ডায়মন্ড ব্যাটারি বা ডায়মন্ড নিউক্লিয়ার ভল্টেয়িক নামে পরিচিত। ইউনিভার্সিটি অফ ব্রিস্টলে ড. নিল ফক্সের টিম এই প্রোটোটাইপ ডায়মন্ড নিউক্লিয়ার ব্যাটারির উদ্ভাবন করেছেন কার্বন-১৪ আইসোটোপ দিয়ে।
নিউক্লিয় বর্জ্যের একটা বড় অংশজুড়ে আছে সি-১৪ আইসোটোপটি। তাই নিউক্লিয়ার বর্জ্য রিসাইক্লিং-এ ডায়মন্ড নিউক্লিয়ার ব্যাটারির উদ্ভাবন নিঃসন্দেহে একটি বড় ধাপ।
ড. নিলের এই টিম নিউক্লিয়ার প্ল্যান্টগুলোর বর্জ্য থেকে কার্বন ১৪ নিয়ে সিন্থেসাইজ করে তৈরি করেন ডায়মন্ড। ল্যাবে তৈরি করা এই সিঙ্গেল ক্রিস্টালাইন ডায়মন্ড (SCD) দিয়েই বানানো হচ্ছে রেডিওএক্টিভ ডায়মন্ড ব্যাটারি এবং এর অন্যান্য ভেরিয়েন্টগুলো যার মধ্যে ন্যানো ডায়মন্ড ব্যাটারি বা এনডিবি অন্যতম।
এনডিবি ইনকর্পোরেশন নামক ক্যালিফোর্নিয়ার প্রতিষ্ঠানটি ২০২৩ সাল নাগাদ ন্যানো ডায়মন্ড ব্যাটারি বা এনডিবি বাজারে ছাড়ার প্রতিশ্রুতি জানিয়েছেন। এই এনডিবি ব্যাটারিই নিরবিচ্ছিন্ন শক্তির জোগান দিতে পারবে একটানা ২৮,০০০ বছর, প্রয়োজন হবে না কোনো রিচার্জ বা পার্ট রিপ্লেসমেন্টের।
এই রেডিওএক্টিভ ডায়মন্ড ব্যাটারির প্রয়োগও হবে সুদূরপ্রসারি। স্মার্টফোন ও গাড়িতে ব্যাবহার থেকে শুরু করে, ডিপ স্পেস মিশনেও ব্যবহার করা হবে এই প্রযুক্তি। এতে করে স্পেস প্রোব বা মার্স রোভারের মতো অটোনোমাস রোবটকে সূর্যের আলোর বা ঝুঁকিপূর্ণ আরটিজি ব্যাটারির উপর নির্ভর করে থাকতে হবে না।
কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে এই ব্যাটারি সবচেয়ে বড় প্রভাব ফেলবে মেডিক্যাল সেক্টরে। বর্তমানে ব্যবহৃত সকল মেডিক্যাল ইমপ্ল্যান্টই লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির উপর নির্ভরশীল যার স্থায়ীত্বকাল খুবই কম। কিন্তু সম্পূর্ণ ঝুকিমুক্ত এই রেডিওএক্টিভ ডায়মন্ড ব্যাটারি প্রযুক্তি মেডিক্যাল বা সারজিকাল ইমপ্ল্যান্টে (যেমন হিয়ারিং এইড, পেসমেকার, ইত্যাদি) ব্যাবহার হলে তার ব্যাটারি বদল বা রিচার্জ করা নিয়ে একদমই ভাবতে হবে না।
শিল্প কারখানাতেও এই প্রযুক্তি আনবে ব্যাপক পরিবর্তন। ডাটা সেন্টারগুলোকে ভুগতে হবে না কোনো রকম পাওয়ার আউটেজে। এনডিবির অফুরন্ত আর নিরবিচ্ছিন পাওয়ার সাপ্লাইয়ের উপর নির্ভর করে ডাটা সেন্টার ও পয়েন্টগুলো এক মুহূর্তের জন্যও অফলাইনে থাকতে হবে না যা কমিউনিকেশন ও ভবিষ্যতের হাইপারকমিউনিকেশনকে করবে আরো মজবুত।
ব্যাক্তিগত পর্যায়ে এই ব্যাটারি ব্যবহৃত হবে স্মার্ট ফোন, স্মার্ট ওয়াচ, ল্যাপটপ সহ সকল প্রকার কঞ্জিউমার ইলেকট্রনিক্সে যা মোবাইল বা পোর্টেবল ডিভাইসগুলোর নামের সার্থকতা আনবে। পাওয়ার আউলেট খোঁজার বা ফোন চার্জ দেয়ার জন্য সাথে বহন করতে হবে না ক্যাবল, প্রকৃতপক্ষেই ফোনগুলো হবে ‘মোবাইল’।
টেসলা ও টয়োটা প্রিয়াসের মতো ইলেক্ট্রিক কারগুলোতে এই ব্যাটারি প্রযুক্তি ব্যবহারে গাড়িগুলোর রেঞ্জ বর্তমানের গড় ২০০-৩০০ কিলোমিটার থেকে বেড়ে হাজারের ঘরে পৌঁছবে যার কারনে গতানুগতিক ডিজেল বা অকটেন চালিত গাড়ির প্রতি মানুষের ঝোঁক আরো কমবে। এতে করে হ্রাস পাবে বৈশ্বিক কার্বন এমিশন।
বস্তুত, কার্বন ১৪ ব্যবহৃত এই বেটাভল্টেয়িক ব্যাটারি সঠিক প্রয়োগ করা গেলে আমরা পাবো অফুরন্ত একটা এনার্জি সোর্স যা চলবে শুধু নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টের বর্জ্য থেকে। গ্রিন এনার্জির সন্ধানে এটি হবে একটি মাইলফলক এবং অনাকাঙ্ক্ষিত নিউক্লিয়ার বর্জ্য অপসারণে আমরা এগিয়ে যাবো আরো এক ধাপ।
Pingback: Nano-Diamond Battery – the future of Betavoltaics? – Rifat Ahmed