গুটি কয়েক শিক্ষকদের পদত্যাগ করার বিষয়টা দূর থেকে খুব হৃদয়বিদারক মনে হলেও শুধুমাত্র ঐ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাই তাদের আসল রূপটা চেনে। তাই সোশ্যাল মিডিয়ায় মায়া জড়ানো মিউজিক দেয়া ভিডিও দেখে বিভ্রান্ত হবেন না। ছোট্ট করে বলতে হলে, ভারত হবেন না।
ভারতের মিডিয়াও কিন্তু শেখ হাসিনা পালানোর পর বাংলাদেশকে নিয়ে আফসোস করতে শুরু করেছিলো। তারা আমাদেরকে এক অকৃতজ্ঞ জাতি হিসেবে প্রচার করছিলো। তারা বোঝাতে চাচ্ছিল যে আমরা এমন এক জাতি যারা শেখ হাসিনার আমলে হওয়া অবকাঠামোগত উন্নয়ন ভুলে অকৃতজ্ঞের মতো আচরণ করছি। কিন্তু শেখ হাসিনা এবং তার ফ্যাসিবাদি আচরণ শুধু আমরা বাংলাদেশিরাই জানি। আমরাই জানি প্রতিটি মেগা প্রজেক্টের বাহানায় কত মিলিয়ন-বিলিয়ন ডলার লুট করেছিলো ক্ষমতাসীনরা। শুধু এক রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্প থেকেই শেখ হাসিনা এবং তার পরিবার ৫ বিলিয়ন ডলার আত্মসাৎ করেছে, যা আমরা নিজেরাই জানতে পেরেছি কিছুদিন হলো। তাছাড়া তার আমলে দেশ থেকে পাচার-ই হয়ে গেছে ১৫০ বিলিয়ন ডলার। এসবের উপর আবার গুম, চাঁদাবাজি, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি আর কয়েক হাজার খুনের অপরাধ তো আছেই।
বাইরের দেশের কাছে হয়তো শুধু তার আমলের মেগা প্রজেক্টের খবর গুলোই পৌঁছেছে। এজন্যই ভারতীয়রা হয়তো হাসিনার প্রতি এত দরদ দেখাচ্ছিলো। তারা হয়তো জানে না হাসিনা এবং তার সরকারের প্রকৃত রূপ। তার এই প্রকৃত চেহারা কেবলমাত্র আমরা বাংলাদেশিরাই জানি। তাই এই বিষয়ে ভারতের মন্তব্যের কোনো দামই নেই। শিক্ষকদের ক্ষেত্রেও ঘটনাটা এমন-ই।
আপনার আমার কাছে হয়তো সে একজন সমাজের সম্মানিত শিক্ষক। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে হয়তো সে একজন চরিত্রহীন লম্পট যে মেয়ে শিক্ষার্থীদের সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ করে। অথবা সে হয়তো শিক্ষকতা পেশার আড়ালে কোচিং ব্যবসা চালায় যেখানে না পড়লে তার সাবজেক্টে পাশ করা যায় না। অথবা সে হয়তো এক দুর্নীতিবাজ প্রিন্সিপাল যে বছরের পর বছর টাকার বিনিময়ে বিভিন্ন অযোগ্য নিয়োগ দিয়েগেছেন। অথবা সেই শিক্ষক হয়তো পালিয়ে যাওয়া আওয়ামীলীগেরই দালাল যে তার ছাত্রদের হুমকি দিয়ে গণঅভ্যুত্থান নস্যাৎ করতে চেয়েছিলো।
এগুলো আমরা বাইরের থেকে জানবো না। জানার কথাও না। এগুলো জানবে সেই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকরা কেননা কেবল তারাই নিজেদের সাথে হয়ে যাওয়া এইসব অন্যায় অবিচার হতে দেখেছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, বিনা কারনেই এতগুলো শিক্ষার্থী মিলে তাদের পদত্যাগ করতে বাধ্য করছে না। সেই কারন হয়তো আমরা যারা আমজনতা আছি, জানি না। তবে কারন নিশ্চয়ই আছে।
প্রশ্ন করতেই পারেন তাহলে কেনো তাদেরকে বিচারের আওয়াতায় আনা হলো না? কেন শিক্ষার্থীরা নিজেরা তাদের পদত্যাগ করতে বাধ্য করছে? আপনাদের কাছে তাহলে আমার উল্টো প্রশ্ন। শিক্ষার্থীদের কেন তাহলে হাসিনাকে জোরপূর্বক উৎখাত করতে হলো? কেন আইনের মাধ্যমে বা আদালতের মাধ্যমে তাকে অপসারন করা গেলো না?
কারন, দেশে সঠিক বিচার ব্যবস্থাই নাই। গত দেড় দশকে দেশের বিচার ব্যবস্থা পচে গেছে। যার টাকা আছে, ক্ষমতা আছে, বিচার ব্যবস্থা তার সাফাই গেয়েছে। বিত্তবান বা ক্ষমতাবান কিংবা ক্ষমতাসীনদের দোসর — কারোর-ই বিচার হয়নি। তাই এই মুহূর্তে দেশের বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থা না থাকাটাই স্বাভাবিক।
তাছাড়া শিক্ষকতার পদ থেকে যে অপসারণ করা হচ্ছে, সেটা কিন্তু গণহারেও হচ্ছে না। এমনকি সব প্রতিষ্ঠানেও হচ্ছে না। গুটিকয়েক যেসব প্রতিষ্ঠানে হচ্ছে, সেখানেও এক-দুজন যারা হয় ইভটিজার ছিল, চরিত্রহীন ছিল, কোচিং ব্যবসা করতো, স্কুলের ফান্ড মেরে খেতো অথবা ফ্যাসিবাদের চাটুকার ছিল। এতগুলো শিক্ষার্থীরা মিলে যখন একজনের পদত্যাগ চাইছেন, তখন সেখানে কোনো না কোনো কারন তো অবশ্যই আছে। এই কারনগুলো বা ঘটনাগুলো হয়তো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গন্ডির বাইরে আসে নাই, বা আসার সুযোগও ছিল না।
তাই দেশ থেকে ছাত্ররা যেভাবে দুর্নীতিবাজ, ফ্যাসিবাদ সরকারকে অপসরন করেছে, শিক্ষার্থীদের তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকেও সেই আগাছাগুলোকে সাফ করতে দিন। তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবস্থা তারা নিজেরাই জানে। তারা নিজেরা যেহেতু দেশ শুধরেছে, তাদেরকে নিজেদের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ও শুধরে নিতে দিন।
তবে এসব পদত্যাগের মধ্যে দু-একজন ভালো শিক্ষক কোনো কারনে জড়িয়ে যেতে পারে; এতে সন্দেহ নেই। তবে ১০০ জনের মধ্যে এরকম ১-২ জনের কারনে বাকি ৯৮ জন অসাধু শিক্ষকের অপসারনকে কলুষিত হতে দেবেন না।
কোনো শিক্ষক যদি বিনা কারনে অপসারণ হয়, তা খতিয়ে দেখতে হবে।
কে দেখবে সেটা? আপনি-আমি?
না, আমরা তাদের প্রকৃত চরিত্র সম্পর্কে কিছুই জানি না। তাই না জেনে শুনে আমাদের এই বিষয়ে নাক গলানো উচিত হবে না।
তাহলে কি দেশের বিচার বিভাগ?
হয়তো বা। তবে গত দেড় দশকে বিচার ব্যবস্থার উপর জনগনের যে আস্থা উঠে গেছে সেটা পুন:স্থাপিত হতে সময় লাগবে।
তাহলে কে বা কারা এই মজলুম শিক্ষকদের এই বিষয়টা দেখবে?
আমার ব্যক্তিগত মতে, এই বিষয়টি ঐ স্কুলের সাবেক শিক্ষার্থীরাই সবচেয়ে ভালোভাবে বুঝে একটা সমাধান করতে পারবে। সাবেক শিক্ষার্থীরা, যারা ঐ শিক্ষকের কাছ থেকে পাঠদান গ্রহণ করেছেন, তারা কিছুটা হলেও তার সম্পর্কে জেনে থাকবেন। বাকিটা না হয় স্কুলের বর্তমান শিক্ষার্থী বা শিক্ষকদের থেকে শুনে নিলেন। এরপর চাকরিচ্যুত শিক্ষকের পক্ষ শুনে সব কিছু মিলিয়ে একটা তদন্ত করা যাবে। এই প্রক্রিয়ায় হয়তো সব সত্য উঠে আসবে।
যদি এই অপসরণকৃত শিক্ষকদের কেউ আসলেই ভুল ক্রমে এই অপসারনের শিকার হয়ে থাকে এবং সেটা যদি তথ্য উপাত্ত দ্বারা বিচার বিভাগে বা অ্যালামনাইদের কাছে প্রমাণিত হয়, তাহলে শুধু সেই শিক্ষককে চাকরী ফিরিয়ে দেয়াই উচিত হবে না, সাথে সমস্ত স্কুলের শিক্ষার্থী এবং স্টাফদের পক্ষ থেকে ক্ষমা চাওয়া পূর্বক তাতে সসম্মানে স্কুলে ফিরিয়ে নিতে হবে। শুধু তাই নয়, চাকরিচ্যুত থাকা সময়ের বেতনও তাকে সসম্মানে বুঝিয়ে দিতে হবে।
শিক্ষকদের প্রতি ব্যক্তিগতভাবে আমার সম্মানের কোনো কমতি নেই। এখনও যদি কোনো স্যারের সামনে পড়ে যাই , দু-হাত অটোমেটিক পিছে গিয়ে কাঁচুমাচু হয়ে যায়, চোখ সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে। তবে আমার সৌভাগ্যও বটে যে আমি দেশের প্রথম সারির প্রতিষ্ঠানগুলোতে থেকে পড়াশুনা করার সুযোগ পেয়েছি। সেই ছোটো বেলা থেকেই শিক্ষকদের বিষয়ে নিজেকে খুবই লাকি মনে করি। কড়া অনেক শিক্ষক পেয়েছি, তবে চরিত্রহীন বা ম্যোরালি করাপ্টেড একজনও না। এজন্যই হয়তো আমার স্কুল এবং কলেজ থেকে এখনও কাউকে অপসারন করার মতো লজ্জাজনক ঘটনা ঘটেনি। এই দিকে থেকে নিজেকে খুবই সৌভাগ্যবান মনে করি। তবে মফস্বল এলাকায় বা গ্রামের দিকে শিক্ষার্থীরা হয়তো আমার মতো সৌভাগ্যবান নয়, যার কারনে এসব অপসারণের ঘটনা ঢাকার বাইরেই বেশি হচ্ছে।
তবে ঠিক এখন-ই মায়া ভরা মিউজিক দেয়া ভিডিও দেখে অপসরণকৃত শিক্ষকদের জন্য সাফাই গাওয়া যাবে না। মনে রাখতে হবে, একজন সৎ এবং নিষ্ঠাবান শিক্ষকদের সাথে ছাত্ররা এরকম আচরণ করতে পারে না। তাই যাদেরকে চাকরিচ্যুত করা হচ্ছে, তাদের মায়া কান্না বা ভিডিও দেখে দেশব্যাপি এই আগাছা দমনকে কলুষিত করা যাবে না। মায়া কান্না কিন্তু আমাদের সাবেক প্রধানমন্ত্রীও ভালোই জানতেন। তাই এসব ভিডিও দেখে গলে গেলে হবে না। শিক্ষার্থীরা যেভাবে দেশ থেকে আগাছা সরিয়ে নতুন এক বাংলাদেশের গড়ে তোলার প্রথম পদক্ষেপ নিয়েছে, সেই সুযোগটুকু তাদেরকে তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও দিতে হবে।