গুজবের ভয়াবহতার একটা সাম্প্রতিক উদাহরণ দেই।
আমরা যখন এদেশে স্বৈরাচার হটাতে ব্যস্ত তখন সুদূর ইংল্যান্ডে একটা ১৭ বছর বয়সের যুবক একসাথে তিনটা বাচ্চা মেয়েকে খুন করে এবং কয়েকজনকে ছুরিকাঘাত করে আহত করে। সেই ছেলেটার চেহারা যখন সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়, তখন কেউ একজন ছেলেটাকে মুসলমান দাবী করে এমন কিছু মন্তব্য করে যার কারনে দেশের বিভিন্ন জায়গায় এন্টি-মুসলিম দাঙ্গা শুরু হয়। বিভিন্ন ইসলামিক ইন্সটিটিউটে ভাংচুর হয়। ধীরে ধীরে সেটা এন্টি-ইমিগ্রেন্ট দাঙ্গায় রূপ নেয়। মুসলমানদের বাসায় হামলার পাশাপাশি যেই সব অফিস-আদালত এবং লয়ার এজেন্সি তাদের সাহায্য করতো, তাদের উপরও হামলা হয়।
শেষমেশ যদিও প্রমাণিত হয় যে ছেলেটা ব্রিটিশ নাগরিক, নাম এক্সেল রুডাকুবানা এবং ইসলামের সাথে তার কোনো সম্পর্ক নাই, ততক্ষণে ঘৃণা যা ছড়ানোর ছড়িয়েছে গেছে এবং ক্ষয়ক্ষতি যা হবার কথা হয়ে গেছে। হতাহতের সংখ্যা এখনও পুলিশ প্রকাশ করে নাই তবে কয়েকশত লোক আটক হয়েছে, আহতও হয়েছে বেশ কিছু।
বৃটেনের পুলিশ এখন এই এন্টি-মুসলিম দাঙ্গা ঠেকানোর জন্য খুব জোরে সোরে নেমে পড়েছে। এখন হয়তো পরিস্থিতি একটু ঠান্ডা আছে।
ঠিক এই কারনে গত দু-দিন ভারতীয় গনমাধ্যম নিয়ে একটু চিন্তায় ছিলাম। মিস-ইনফরমেশন ছড়াতে ছড়াতে এমন এক পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে কিছু টুইট দাবী করতেছিলো আমাদের দেশে হিন্দুদের গনহত্যা চলতেছে। হাজার হাজার হিন্দুদের পুড়িয়ে তাদের লাশ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। দেশের আওয়ামীলীগের বিরুদ্ধে যেই দাঙ্গা হচ্ছিলো, সেগুলোকেও হিন্দুদের বিরুদ্ধে দাঙ্গা বলে চালিয়ে দেয়া হচ্ছিল।
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এরকম কোনো গনহত্যাই হয় নাই হিন্দুদের বিরুদ্ধে। বেশ কিছু জায়গায় ভাঙচুর হয়েছে, জ্বালাও পোড়াও হয়েছে। সেটা যেমন আওয়ামী নেতাদের বা সাধারণ মুসলমানদের বাড়িতে হয়েছে, হিন্দুদের বাড়িতেও হয়েছে। বিশেষ করে হিন্দুদের মন্দিরগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।
এগুলো খুব সহজেই ঠেকানো যেত মিলিটারি ডিপ্লয় করে। তবে ভারতের সিম্প্যাথি পাওয়ার জন্য এটাই হয়তো হাসিনার শেষ চাল ছিল।
যখন পুরো দেশে অরাজকতায় নিমজ্জিত তখন দেশে কোনো বাহিনী-ই সেভাবে একটিভ ছিল না। থাকলে সবগুলো মন্দির আর হিন্দু বাড়িঘর-ব্যবসা এই সন্ত্রাসীদের হাত থেকে বাঁচানো যেত।
তবে কথা হচ্ছে, কোথায় হাজার হাজার হিন্দুদের মেরে গনহত্যা চলে নি। হিন্দুদের শত শত মৃত লাশ ঝুলিয়েও রাখা হয় নি। শুধুমাত্র হিন্দুদের-ই বাড়িঘর জ্বালাও পোড়াও হয়নি। তবে ভারতে অনেকের কাছে এর উল্টো বার্তাটাই পৌছাচ্ছিল। অনেকে প্যালেস্টাইন, যেখানে প্রকৃতপক্ষে গনহত্যা চলছে, তার সাথে বাংলাদেশের তুলনা দিচ্ছিলো। এরকম মিস-ইনফরমেশন কতগুলোই আর রিপোর্ট করে রিমুভ করা যায়?
মুসলিম বিদ্বেষ যা ছড়ানোর তা ছড়িয়ে গিয়েছে ভারতে। এর প্রভাব নিশ্চয়ই ভারত-বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক এবং ভারতে মুসলিম মাইনোরিটি-র উপর পড়বে। এসবের জন্য মূলত দায়ী (১) বাংলাদেশের কিছু সন্ত্রাস যারা মুসলমান ঘরে জন্ম নিয়েছে ঠিকই কিন্তু ধর্মীয় শিক্ষা নেয় নি।, (২) ভারতীয় গণমাধ্যম যাদের শুধু নিউজ বিক্রি করা দিয়ে কথা এবং (৩) বাংলাদেশি এবং ভারতীয় সাধারণ নাগরিক যারা সোশ্যাল মিডিয়ায় সঠিক ব্যবহার এখনও শিখতে পারে নি।
ইন্ডিয়ানদের তেমন দোষ দিয়ে লাভও নেই। ওরাও বাংলাদেশিদের মতো অতি-আবেগী। ধর্ম নিয়ে কথা উঠলেই কারো বাপ-মা উদ্ধার বাকি থাকে না। তথ্য ভেরিফাই করার আগেই ঘৃণা ছড়িয়ে যায়। এখন ভারতে আমাদের ইস্যু নিয়ে কি অবস্থা জানি না। গতকাল সারাদিন এক্সে বাংলাদেশ নিয়ে যা দেখেছি, মুসলমানদের নিয়ে যত খারাপ কথা শুনেছি, এর পরে আর আবার সেগুলো ঘাটাঘাটি করার মানসিক শক্তি নাই।
তিনটা পয়েন্ট বলে শেষ করতে চাই।
(১) এই সিচুয়েশনে কারফিউ বা জরুরি অবস্থা জারি না করা ছিল জাতিগতভাবে আমাদের সবচেয়ে বড় ভূল।
(২) সন্ত্রাসীদের এভাবে ধর্মের সাথে লিংক করার মনোভাবটা আমাদের অতিসত্বর ত্যাগ করতে হবে।
(৩) যেকোনো তথ্য শেয়ার করার আগে একটু ভেরিফাই করে নিতে হবে। চেক করতে হবে যে ইনফরমেশনটা কোনো রিলায়েবল সোর্স থেকে পাওয়া কিনা। এই তথ্য প্রযুক্তির যুগে এটা তেমন কঠিন কিছু না। আপনি যদি এতটুকুও না পারেন, তবে প্রতিজ্ঞা করেন যে আজ থেকে ভেরিফাইড সংবাদ মাধ্যমে ছাড়া কোনো র্যান্ডম পেজ বা প্রোফাইলের কোনো কিছু শেয়ার করবো না। এতে করে গুজব ছড়ানো সম্পূর্ণ বন্ধ না হলেও, ৯৫ শতাংশ কমে যাবে।