যারা ‘আগেরটাই ভালো ছিল’—এই কুচিন্তার ধারে-কাছেও আছেন তাদের জন্য গতমাসে আমার পাওয়া একটা ইমেইলের অংশবিশেষ।
… We are unable to process your orders for the above-named company as we do not accept applications where one of the people in the company is currently a resident of Bangladesh. We have deemed orders from this country to be of high risk due to weak anti-money laundering regulations and/or a high risk of terrorist financing. …
আমার প্রতিষ্ঠানটি মূলত ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে একটি একক মালিকানাধীন কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধনকৃত। তবে বাইরের দেশের ক্লায়েন্টদের ম্যানেজ এবং বিল-পেমেন্ট সংক্রান্ত কিছু বিষয়াদির জন্য আমি ডেফ্টাইল্ড-কে যুক্তরাজ্যে একটি শেয়ারভিত্তিক প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি হিসেবেও নিবন্ধন করি।
প্রতি বছর যেমন বাংলাদেশে ইনকাম ট্যাক্স রিটার্ন এবং ভ্যাট জমা দেয়া লাগে, ইউকে-তেও ব্যবসার কর্পোরেশন ট্যাক্স দেয়ার জন্য একাউন্টস সাবমিট করতে হয়। কিন্তু যেহেতু আমি নিজে প্রতিবছর ইংল্যান্ডে গিয়ে এগুলো জমা দিয়ে আসতে পারি না, এই সব দাপ্তরিক কাজের জন্য ইউকে-এর একটি সরকারী এজেন্সির হেল্প নিতাম। এবছরও একাউন্টস জমা দেয়ার জন্য তাদের ফাইলিং সার্ভিস অর্ডার করি গত মাসে। কিন্তু আমি বাংলাদেশি হওয়ার কারনে তারা আমার কোম্পানির জন্য ট্যাক্স ফাইল রেডি করে দিবে না বলে জানায়। অর্ডার ক্যান্সেল করে রিফান্ডও দিয়ে দেয়। ইমেইলে যদিও দুটি সম্ভাব্য কারন বলে দিয়েছে তারপরও কনফার্ম হওয়ার জন্য তাদের সাপোর্টে যোগাযোগ করি। জানতে পারি যে ইউকে সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী যেসব লিমিটেড কোম্পানির বোর্ডে বাংলাদেশি শেয়ার হোল্ডার আছে সেসব কোম্পানির পরিচালনা বিষয়ে কোনো হেল্প তারা করবে না। কেননা ব্রিটিশ সরকারে চোখে বাংলাদেশ মানি লন্ডারারদের অভয়ারণ্য।
গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১৫০ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়ে গেছে।
আমাদের দেশে খরচযোগ্য রিজার্ভ কতো আছে জানেন?
মাত্র ১৫ বিলিয়ন ডলারের মতো। অর্থাৎ এই মুহূর্তে ১৮ কোটি মানুষের পুরো দেশের খরচ মেটাতে যে পরিমাণ অর্থ দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে মজুদ আছে তার দশ গুন দেশ থেকে পাচার হয়ে গেছে এক সরকারের আমলেই।
তাছাড়া আমাদের দেশের ঘাড়ে যে ১০০ বিলিয়ন ডলার ঋণ রয়েছে, তার ৮৫ শতাংশই ঋণ করা হয়েছে গত ১৫ বছরে।
এসব কিছু জানার পড়েও ইউকে সরকারকে কিভাবে দোষ দেই?
আমাদের দেশে যে পরিমাণ মানি লন্ডারিং হয়ে গেছে গত দেড় দশকে, আমার নামে যে ব্রিটিশ সরকার এতদিন তাদের দেশে ব্যবসা চালানোর জন্য মামলা দিয়ে দেয় নাই সেটাই বেশি।
প্রতিবছর সময় মতো ইনকাম ট্যাক্স রিটার্ন জমা দেই। ৩০ জুন ট্রেড লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হয়; ১ জুলাই সকালে সবার আগে ব্যবসার লাইসেন্স রিনিউ করি। ডলার যদি খোলা মার্কেটে বিক্রি করি, ডলার প্রতি ১০-১২ টাকা বেশি বিক্রি করতে পারি। ব্যবসার লাভ, নিজের লাভ, ইমপ্লয়িদেরও একটু বেশি বেতন দিতে পারি। কিন্তু সেটা না করে দেশের কথা চিন্তা করে বছরে কয়েক লাখ টাকা এভাবেই ছেড়ে দিয়ে ব্যাংকে সব টাকা আনি। এসব কিছুর বদলে এই সরকার যাওয়ার আগে আমাকে কি দিয়ে গেছে জানেন? বহির্বিশ্বের কাছে আমার পরিচয় হিসেবে একটা ‘মানি লন্ডারার’-এর পরিচয় দিয়ে গেছে।
ছাত্রদের গনহত্যা তো দেখলেন-ই। আয়নাঘরের বাস্তবতাও সবার কাছে স্পষ্ট। চাকরিতে কি পরিমাণ দলীয় নিয়োগ হতো তার কাগজে সামনে আসতে শুরু করেছে। এত কিছু দেখার পরেও যদি ‘আগেরটা ভালো ছিল’ এরকম কুচিন্তা মাথায় আসে, মাথাটা খুলে ছাত্রদের দান করে দেন। ফুটবাল বানিয়ে খেলুক।
তবে আশার কথা হলো নতুন অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হয়ে গেছে। ড. ইউনূস-কে নিয়ে আমার ও এদেশের মানুষের অনেক আশা। বিশেষ করে অর্থনীতিতে। উনি দেশ পরিচালনায় কতটা সক্ষম সেটা সময়-ই প্রমাণ করে দেবে। তবে অর্থনীতি উনার প্লেয়িং গ্রাউন্ড। উনি এই বিষয়ে পণ্ডিত। তাছাড়া দেশ-বিদেশে নাম-ডাক, সম্মান, খ্যাতি — সবই আছে উনার। আশা করি উনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারে ‘ঋণগ্রস্থ জাতি’, ‘চোরের দেশ’, ‘অর্থ পাচারকারী রাষ্ট্র’ এসব ট্যাগ থেকে মুক্তি পেয়ে যাবে।