দেয়ালের কোণায় বা সিলিংয়ে লটকে থাকা টিকটিকি আমাদের খুবই পরিচিত একটি দৃশ্য। বেডরুম, লিভিং রুম, ওয়াশরুম কিংবা জানালার বাইরে দিয়ে পাশের বিল্ডিংয়ের দেয়ালে নিঃশব্দে দৌড়ে বেড়ানো এই সরীসৃপ আমাদের কাছে তেমন বিশেষ মনে না হলেও বুকে ভর দিয়ে চলা এই টিকটিকি কিন্তু প্রকৃতির একটি ব্যতিক্রম সৃষ্টি। নিজেই একবার চিন্তা করে দেখুন – টিকটিকির মতো এভাবে সিলিংয়ের মসৃণ তলে উল্টো হয়ে চলতে দেখেছেন কি অন্য কিছুকে?
বাদুড়কে হয়তো উল্টো হয়ে গাছের ডাল ধরে ঝুলতে দেখছেন। বানরকে হয়তো ডাল ধরে ঝুলে ঝুলে চলতে দেখেছেন। কিন্তু টিকটিকির মতো কোনো প্রাণীকে এভাবে কোনো মসৃণ পৃষ্ঠে উল্টো হয়ে চলাফেরা করতে কি দেখেছেন?
উত্তরটা “না” হওয়ার কথা।
সামান্য টিকটিকির এই অসামান্য ক্ষমতা আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণে ব্যর্থ হলেও ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াটারলুর একদল ইঞ্জিনিয়ারের নজর ঠিকই কেড়েছে।
টিকটিকির পাশাপাশি ইঞ্চওয়ার্ম বা এক ধরনের শুঁয়াপোকার গাছের পাতায় ভাজে ভাজে চলার ক্ষমতাও অনুপ্রাণিত করেছে কানাডিয়ান এই ইঞ্জিনিয়ারদের।
মধ্যাকর্ষণের বিপরীতে দেয়াল বা সিলিংয়ের সাথে লেগে লেগে চলা টিকটিকি-র (Gecko) এই ক্ষমতা ও ইঞ্চওয়ার্মের (Inchworm) গতিবিধির ধরন থেকে প্রভাবিত হয়ে তৈরি করেছেন Gecko Inchworm Robot বা গেউবট (GeiwBot) নামের এক সফ্ট রোবট।
জিয়ান সুন, লুকাস বাওমান, লি ইউ এবং বক্সিন ঝাও-য়ের তৈরি ছোট্ট এই রোবটটি অতিবেগুনী রশ্মি ও চৌম্বকীয় বল ব্যবহার করে ইঞ্চওয়ার্মের মতো দেহ ভাজ করে এবং টিকটিকির মতো দেয়াল বেয়ে উপরে উঠতে এমনকি সিলিংয়েও চলতে পারে।
তারচেয়েও আশ্চর্যের বিষয় হলো — ৪ সেন্টিমিটার দীর্ঘ, ৩ মিলিমিটার চওড়া ও ১ মিলিমিটার পুরুত্বের এই ক্ষুদ্র রোবটটিকে ব্যবহার করতে প্রয়োজন হবে না কোনো ধরনের শক্তির উৎস বা বাহ্যিক পাওয়ার সোর্সের। তাছাড়া পৃথিবীর প্রথম বাহ্যিক জ্বালানিবিহীন এই সফট রোবটটিকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে দূর থেকেই। এজন্যই মানবদেহের অস্ত্রপাচারের মতো সূক্ষ্ম অপারেশন বা এক্সট্রাকশনের জন্য কার্যকরী একটি টুল হবে এই রোবট।
এই গেউবটটি তৈরি করতে ব্যবহার হয়েছে আলো-সংবেদী পলিমার স্ট্রিপ এবং লিকুইড ক্রিস্টাল ইলাস্টোমার্স-এর মতো কিছু স্মার্ট ম্যাটেরিয়ালের ও সিন্থেটিক এডহেসিভ প্যাড।
দেহের মধ্যাংশে থাকা পলিমার স্ট্রিপটি অতিবেগুনি রশ্মির প্রতি সংবেদনশীল। অতিবেগুনী রশ্মির সংস্পর্শে এই স্ট্রিপটি শুঁয়াপোকা বা ইঞ্চওয়ার্মের মতো ভাজের মাধ্যমে নিজেকে সঙ্কুচিত করে আগে পেছনে চলাচলের জন্য প্রস্তুত করে।
গেউবটের দুই প্রান্তে থাকা টিকটিকির পায়ের মতো আঠালো প্যাডে থাকে চৌম্বকীয় কম্পোজিট ফিল্ম, মাশরুমের মতো সাকশন পিলার ও আঠালো ভিস্কোইলাস্টিক ফিল্ম। চৌম্বক ক্ষেত্র ব্যবহার করে দুই প্রান্তের দুই প্যাডকে পর্যায়ক্রমে পৃষ্ঠতলে বসানো (Attachment State – AS) বা উঠানো (Detachment State – DS) হয়। এই প্রক্রিয়ায় টিকটিকির মতোই গেউবট সফ্ট রোবটটি এর পৃষ্ঠতলের গ্রিপ খুব সূক্ষ্মভাবে নিয়ন্ত্রন করতে পারে।
প্রশ্ন জাগতে পারে কিভাবে একটি রোবট, যার দেহে কোনো শক্তির উৎস নেই, চলাফেরা করতে পারে?
যদি পুরো রোবটটিকে একটি শুঁয়াপোকার সাথে তুলনা করা হয় তবে প্রথমে চৌম্বকক্ষেত্র ব্যবহার করে শুঁয়াপোকার লেজের অংশ পৃষ্ঠতল থেকে উঠানো হয়। লেজের অংশ উঠানো অবস্থায় বাইরে থেকে অতিবেগুনী রশ্মি ফেলা হয় রোবটটি দেহে। এতে করে শুঁয়াপোকার দেহের মতো রোবটের দেহ সংকুচিত হয়ে লেজ সহ কিছুটা সামনে দিকে এগিয়ে আসে। অতিবেগুনী রশ্মি সরিয়ে ফেলা হলে রোবটের দেহ নিচের দিকে চলে আসে এবং চৌম্বক ক্ষেত্র ব্যবহার করে লেজের অংশ পুনারায় লেগে যায় পৃষ্ঠের সাথে।
একই প্রক্রিয়ায় মাথার অংশ উঠিয়ে অতিবেগুনী রশ্মির ব্যবহার করে দেহকে পুনরায় সামনের দিকে নিয়ে আসা হয়। রোবটের দেহ কিছুটা এগিয়ে এলে আবার মাথার অংশ নিচে নেমে লেগ যায় পৃষ্ঠের সাথের। এভাবেই কোনো রকম জ্বালানী বা শক্তির উৎস ছাড়াই শ্রেফ বাইরে থেকে অতিবেগুনী রশ্মি ও চৌম্বক ক্ষেত্র ব্যবহার করে এই রোবটকে সামনে পিছনে এগিয়ে নেয়া যায়।
গেউবটের নানাবিধ ব্যবহার থাকলেও সার্জারিতে ব্যবহারের জন্যই মূলত এই রোবটের সৃষ্টি। যেহেতু এটি কোনো শক্তির উৎস ছাড়াই চলতে পারে এবং উল্টো হয়েও কোনো পৃষ্ঠতলের সাথে লেগে থাকতে পারে, মানবদেহের ভিতরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গয়ে অস্ত্রোপচারে জন্য এই সফ্ট রোবট খুবই উপযোগী।
এই ক্ষুদ্র রোবটটিকে হৃদযন্ত্রের সার্জারির মতো অনেক জটিল অপারেশনেই ব্যবহার করা যাবে কেননা এটি টিকটিকির মতোই মানবদেহের পিচ্ছিল, মসৃণ এমনকি আঁকাবাঁকা অঙ্গের উপর দিয়েও চলাফেরা করতে পারবে।
তাছাড়া গেউবটের ব্যবহারে হার্টের ব্লকের বা অন্যান্য সার্জারির জন্য রোগীর বুক চিড়ে অপারেশনের প্রয়োজন হবে না। অন্ত্র, খাদ্যনালী কিংবা পাকস্থলীর অপারেশনেও ব্যবহার করা যাবে একে। অস্ত্রোপচারের পাশাপাশি সূক্ষ্ম ইঞ্জিনিয়ারিং বা বায়োকেমিক্যাল ডিফেন্সে, যেখানে মানুষের জন্য যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ বা অসম্ভব, এসব কাজেও ব্যবহার করা যাবে এই রোবটকে।
কানাডিয়ান গবেষক দলের বহু বছরের প্রচেষ্টার ফল, এই গেউবট সৃষ্টির মাধ্যমে রোবটিক্সে যুক্ত হয়েছে নতুন এক প্রকার হলিস্টিক সফট রোবট যা ইনভার্ট ক্রসিং বা উল্টো হয়েও চলতে পারে। চিকিৎসাক্ষেত্র ও রোবোটিক্সের পাশাপাশি বায়োমিমিক্রিতেও এক ধাপ এগিয়ে গিয়েছে এই সফট রোবট প্রযুক্তি।