বিবর্তন ও পরিবর্তন প্রকৃতির নিয়ম হলেও কৃত্রিমতাও এর ঊর্ধ্বে নয়। মানবসৃষ্ট প্রযুক্তিকেও একটি নির্দিষ্ট সময় পর পর বিবর্তিত ও অভিযোজিত হতে হয় প্রয়োজনের সাথে। ইন্টারনেটও এর ব্যতিক্রম নয়।
আমাদের প্রয়োজনেই প্রায় ৪ দশকে দুই প্রজন্ম পেড়িয়ে ইন্টারনেট এখন ৩য় প্রজন্মে পা দিতে চলছে। আর আগামীর এই থার্ড-জেন ইন্টারনেটকেই প্রযুক্তিবিদরা ডাকছেন ওয়েব ৩.০ নামে।
কিন্তু ওয়েব ৩.০ আসলে কি?
ওয়েব ৩.০ বা ওয়েব৩ কি তা বুঝতে হলে আগে জেনে আসতে হবে এর পূর্বসূরি ওয়েব ১.০ এবং ওয়েব ২.০ সম্পর্কে।
ইন্টারনেটের সূচনালগ্নে ওয়েবসাইটগুলো ছিল স্ট্যাটিক বা ওয়ান ওয়ে। অনেকটা পত্রিকার মতো।
পত্রিকা যেমন আপনি হাতে নিয়ে শুধু পড়তে পারেন কিন্তু আপনার মতামত সেই পত্রিকার সম্পাদক ও রিপোর্টারদের বা পত্রিকার অন্যান্য পাঠকদের জানাতে পারেন না, ওয়েব ১.০ ঠিক এমনটাই এক তরফা ছিল যা শুধু পড়া বা স্ক্রিনে দেখা যেত। যেকোনো ওয়েবসাইটে প্রবেশ করে শুধু তার কন্টেন্ট পড়া যেত। মন্তব্য বা প্রতিক্রিয়া জানানোর কোনো সুযোগ ছিল না। ছিল না ব্যবহারকারীদের নিজের ডাটা শেয়ার করার সুবিধাও। তাই ২০০৪ সালের আগ পর্যন্ত সময়কার ওয়েব ১.০ কে বলা হতো ‘রিড অনলি ওয়েব’।
কিন্তু ২০০৪ সালে ওয়েব ২.০-এর আগমনে ইন্টারনেট জগতে সম্পূর্ণরুপে বদলে গেল। রিড অনলি ওয়েব হয়ে গেল ইন্টার্যাক্টিভ ওয়েব।
এখন ইউটিউবে সংবাদের নিচে সবাই জানাতে পারছে তার মন্তব্য। নিউজ পোর্টালে সংবাদের নিচে জানাতে পারছে তার মতামত। ফেসবুকে পোস্ট করতে পারছে নিজের অভিব্যাক্তি। কন্টেন্ট ক্রিয়েটর ও তার অডিয়েন্সের মধ্যে তৈরি হচ্ছে টু-ওয়ে কমিউনিকেশন।
আপাতদৃষ্টিতে এটি ব্যবহারকারীদের জন্য আশীর্বাদ স্বরুপ মনে হলেও ওয়েব ২.০ বা এখনকার ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের জন্য গড়ে উঠেনি। এটি গড়ে উঠেছিল ইন্টারনেট জায়ান্ট কোম্পানিগুলোর জন্য।
ওয়েব ২.০ তে যখন থেকে আমরা আমাদের তথ্য, মতামত ও মন্তব্য প্রকাশ করা শুরু করলাম, বিজ্ঞাপনদাতারা সেই তথ্য ব্যবহার করে আমাদের সাইকোলজিক্যাল প্রোফাইল তৈরি করা শুরু করলো। আমাদের থেকে নেয়া তথ্য দিয়ে গড়ে ওঠা পার্সোনাল প্রোফাইলগুলো ব্যবহার করা শুরু হলো আমাদেরকেই বিজ্ঞাপন দেখিয়ে আমাদের ক্রয়-ব্যবহার প্রভাবিত করতে, অধিক মুনাফার আশায়।
তাছাড়া ওয়েব ২.০ হলো সেন্ট্রালাইজ বা কেন্দ্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত। ইন্টারনেট জায়ান্ট গুলো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষেভাবে ব্যবহারকারীদের তথ্য নিজেদের সার্ভারের সংরক্ষণ করার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করে আসছে বর্তমানের ইন্টারনেট, ওয়েব ২.০-কে।
ইন্টারনেটের এই কর্তৃত্ব ইন্টারনেট জায়ান্ট কোম্পানি বা নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাদের কাছ থেকে নিয়ে ব্যবহারকারীদের হাতে তুলে দেয়ার জন্যই ওয়েব ৩.০ এর ধারণার জন্ম।
সহজ করে বলতে গেলে ওয়েব৩ হলো বিকেন্দ্রিক বা ডিসেন্ট্রালাইজড ইন্টারনেট ব্যবস্থা যেখানে থাকবে না কোনো অথোরিটি, থাকবে না কোনো সেন্সরশিপ ও যেখানে ব্যবহারকারীদের ডাটার মালিক হবে ব্যক্তি নিজেই। মেশিং লার্নিং, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, সিমেন্টিক ওয়েব এর উপর গড়ে উঠবে এই প্রজন্মের ইন্টারনেট যেখানে তথ্য সংরক্ষণ ও সুরক্ষার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে ব্লকচেইন।
ওয়েব ২.০ তে যেখানে ইউটিউব চাইলেই আপনার ভিডিও রেস্ট্রিক্টেড বা ডিলিট করতে পারে, টুইটার বা ফেসবুক চাইলেই যেখানে একাউন্ট ব্যান করতে পারে, ওয়েব ৩.০ এর যুগে নিয়ন্ত্রণ হারাবে এই ইন্টারনেট জায়ান্ট গুলো। ওয়েব ২.০ তে যেখানে সোশ্যাল মিডিয়াতে শেয়ার করা তথ্য জমা থাকছে কোম্পানিগুলোর সার্ভারে, সেখানে ওয়েব ৩.০-এ তথ্য সংরক্ষণ হবে ব্যবহারকারীদের ডিভাইসের পিয়ার টু পিয়ার নেটওয়ার্কে।
পিয়ার টু পিয়ার নেটওয়ার্কে ব্যবহারকারীদের ডিভাইসগুলো একে অপরের সাথে সম্পর্কযুক্ত নেটওয়ার্কে থাকে যেখানে ডাটা গুলো সংরক্ষিত থাকে ব্যবহারকারীদের ডিভাইসে। অনেকটা টরেন্টের মতো।
এক্ষেত্রে কোনো নিয়ন্ত্রণকারি প্রতিষ্ঠান চাইলেও কোনো তথ্য মুছে ফেলতে পারবে না ইন্টারনেট থেকে কারন একটি সার্ভার বা ডিভাইস থেকে ডিলেট করা হলেও টরেন্ট নেটওয়ার্কের মতো অন্য ব্যবহারকারীর ডিভাইস বা স্টোরেজে ঠিকই থেকে যাবে ঐ ডাটা।
ওয়েব৩ এর এই পিয়ার টু পিয়ার নেটওয়ার্কের আরেকটি সুবিধা হলো কেন্দ্রীয়ভাবে সংরক্ষিত না থাকার কারনে ওয়েব ২.০ এর যুগে একটি মাত্র সার্ভার হ্যাক করে তথ্য চুরির মতো ঘটনা আর ঘটবে না। তাছাড়া গত বছরে যেভাবে ফেসবুকের সার্ভার ডাউন থাকার কারনে অনলাইন সার্ভিসগুলোতে বিঘ্ন ঘটেছিলো, ওয়েব ৩.০ এর যুগে তা আর হবে না। কেননা ইন্টারনেট সার্ভিস গুলো তখন শুধু একটি নির্দিষ্ট কোম্পানির সার্ভারের উপর নির্ভরশীল থাকবে না।
যেহেতু তথ্যগুলো কোনো কেন্দ্রীয় সার্ভারে থাকবে না তাই বিজ্ঞাপনদাতারা বিজ্ঞাপনের জন্য ব্যবহারকারীদের তথ্যও ব্যবহার করতে পারবে না। এক্ষেত্রে ব্যবহারকারীদের তথ্যের মালিক ব্যবহারকারীরা নিজেরাই হবেন।
তবে ওয়েব ৩.০ এর কিছু স্পষ্ট সমস্যাও রয়েছে।
যেহেতু তৃতীয় প্রজন্মের এই ইন্টারনেট থেকে কোনো কিছু মুছে ফেলা যাবে না, দুষ্কৃতকারীরা ফ্রিডম অফ স্পিচের আড়ালে যে কোনো কিছুই লিখে বা শেয়ার করতে পারবে যে কোনো জায়গা থেকে। এতে করে সাইবার বুলিয়িং, গুজব ও ভূল তথ্য প্রচারের সমস্যা ব্যপক হয়ে দাঁড়াবে আগামীর দিনগুলোতে।
যেহেতু ব্যবহারকারীদের তথ্য কেন্দ্রীয়ভাবে কোথাও সংরক্ষিত থাকবে না, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীদের জন্য এই দুষ্কৃতিকারীদের খোঁজাও অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে।
কিন্তু মুদ্রার ঠিক উল্টোপিঠে এই এনোনিমিটির কারনে অনেক লাভবানও হবেন বিশ্ববাসী। বিকেন্দ্রিক এই ইন্টারনেট ব্যবস্থায় কোনো রকম রাজনৈতিক বা কূটনৈতিক প্রভাব লুকাতে পারবে না সত্য। যেকোনো সময়, যেকোনো ব্যক্তি, পৃথিবীর যেকোনো জায়গা থেকে নিজের পরিচয় গোপন রেখে নির্ভয়ে নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে পারবে।
তার এই মতামত বা তথ্য পরিবর্তন বা মুছে ফেলতে পারবে না কোনো নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাই। তাই ওয়েব৩ কে ‘নো সেন্সরশিপ ওয়েব’ বলেও আখ্যায়িত করেছেন অনেকেই।
যদিও ২০২৩ সাল-ই ওয়েব ৩.০ এর সূচনালগ্ন হবে বলে ধরে নিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা, ওয়েব৩ আসলেই কেমন হবে তা ঠিক এখনই ধারনা করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে এর প্রস্তুতি নিতে হবে এখন থেকেই। ফেসবুকের কর্তা প্রতিষ্ঠান মেটা ও তার সিইও মার্ক জাকারবার্গ ইতিমধ্যে ওয়েব ৩.০ নিয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছেন যা অন্যান্য ইন্টারনেট ভিত্তিক কোম্পানিগুলোকে বাধ্য করছে নিজেদেরকে আসন্ন ওয়েব ৩.০ এর যুগে প্রবেশের জন্য প্রস্তুত করতে।