ফাস্ট চার্জিং কী?

রাতে ফোন চার্জ দিতে ভুলে যাওয়ায় পরদিন সারা দিন পাওয়ার ব্যাংক সঙ্গে নিয়ে ঘোরার অভিজ্ঞতা প্রায় সবারই আছে। তবে ফোন প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলোর নতুন ফাস্ট চার্জিং প্রযুক্তির কল্যাণে এ সমস্যা ইদানীং কিছুটা কমেছে।

ফ্ল্যাগশিপ ফোনগুলো এখন ৬০ ওয়াট, ৮০ ওয়াট, এমনকি ১২০ ওয়াট ফাস্ট চার্জিং পর্যন্ত সাপোর্ট করে। ফলে মাত্র ৩০ থেকে ৪০ মিনিট চার্জ দিলেই হয়। অনায়াসে ফোন চালানো যায় সারা দিন। ফাস্ট চার্জিংয়ের এত সুবিধা থাকার পরও অ্যাপল ও আসুসের মতো কোম্পানিগুলো ফাস্ট চার্জিংকে এখনই এতটা প্রাধান্য দিতে নারাজ। প্রশ্ন হলো, কেন? উত্তর জানতে হলে, আগে বুঝতে হবে ফাস্ট চার্জিং কীভাবে কাজ করে।

ধরুন, একটি নদীতে পাশাপাশি দুটি ব্রিজ আছে। প্রথম ব্রিজটি ১ লেনের আর দ্বিতীয়টি ১০ লেনের। ব্রিজ দুটির এক প্রান্ত থেকে যদি ১০০টি করে গাড়ি ব্রিজ অতিক্রম করতে শুরু করে, তবে দেখা যাবে, প্রথম ব্রিজের ১১তম গাড়িটি ওপাশে পৌঁছানোর আগেই দ্বিতীয় ব্রিজের ১০০টি গাড়িই ব্রিজ পেরিয়ে গেছে। এর কারণ, দ্বিতীয় ব্রিজটি ১০ লেনের। তাই একসঙ্গে ১০টি গাড়ি পাশাপাশি ব্রিজটি অতিক্রম করতে পারে। ফলে ১০ সারিতে মোট ১০০টি গাড়ি ব্রিজ অতিক্রম করতে পারে সহজেই। ওদিকে প্রথম ব্রিজটি মাত্র ১ লেনের হওয়ায় ১০০টি গাড়ির তা অতিক্রম করতে ১০০টি সারি, অর্থাৎ কয়েক গুণ বেশি সময় প্রয়োজন হয়।

এখানে প্রথম ব্রিজটি সাধারণ চার্জিংয়ের উদাহরণ আর দ্বিতীয় ব্রিজটি হলো ফাস্ট চার্জিং। ব্রিজের লেনগুলোকে তুলনা করা যায় ভোল্টেজের সঙ্গে। বোঝার সুবিধার্থে ব্রিজে গাড়ির প্রবাহ বা চলাকে তুলনা করা যেতে পারে তড়িৎ প্রবাহের সঙ্গে।

ঠিক যেভাবে দ্বিতীয় ব্রিজটিতে লেনের সংখ্যা বেশি হওয়ায় একই সংখ্যক গাড়ির ওপাশে পৌঁছাতে অনেক কম সময় লেগেছে, একইভাবে ভোল্টেজ বাড়ানোর মাধ্যমে চার্জিংয়ের জন্য প্রয়োজনীয় সময় কমিয়ে আনা যায় কয়েক গুণ। এ ক্ষেত্রে তড়িৎ প্রবাহের হার বৃদ্ধি কিছুটা প্রভাব ফেললেও মূল ভূমিকা ভোল্টেজের। বিদ্যুতের অপচয় কমাতে প্রায় সব ইলেকট্রনিকস যন্ত্রে হাই ভোল্টেজ ও লো কারেন্ট ব্যবহার করা হয়। তাই ফাস্ট চার্জিং বা যেকোনো চার্জিংয়ে এ নতুন মাত্রা যোগ করতে ভোল্টেজ বাড়ানোই যথেষ্ট। এ কারণেই বেশির ভাগ চার্জারের গায়ে লেখা ভোল্টেজ, অ্যাম্পিয়ারেজের চেয়ে বেশি হয়। মূলত ভোল্টেজ বৃদ্ধির মাধ্যমেই চার্জিংয়ের জন্য প্রয়োজনীয় সময় কমিয়ে আনা হয়।

ধরুন, একটি ৫ ভোল্ট ২ অ্যাম্পিয়ার চার্জার ৫^২=১০ ওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন। এটি বর্তমানে রেগুলার চার্জিং বা স্লো চার্জিং হিসেবে পরিচিত। কিন্তু ভোল্টেজ ৫ থেকে বাড়িয়ে ৩০ করা হলে, তড়িৎ প্রবাহ সেই ২ অ্যাম্পিয়ার থাকার পরও এখন ভোল্টেজ বেশি হওয়ায় তড়িৎ বা বিদ্যুৎ প্রবাহের পরিমাণ যাবে বেড়ে। ফলে ব্যাটারিতে শক্তি সঞ্চারিত হবে আরও দ্রুত। এই ৩০-ভোল্ট^২-অ্যাম্প=৬০ ওয়াট চার্জিং প্রযুক্তির মতো ভোল্টেজ বৃদ্ধির মাধ্যমে ব্যাটারি চার্জের জন্য প্রয়োজনীয় সময় কমিয়ে আনা সব চার্জিং স্ট্যান্ডার্ডই ফাস্ট চার্জিং বা হাই এনার্জি চার্জিং নামে পরিচিত। বাজারে ৩০ থেকে শুরু করে ১২০ ওয়াট পর্যন্ত বিভিন্ন কনফিগারেশনে এ ধরনের চার্জার পাওয়া যায়। ওয়ানপ্লাসের ওয়ার্প চার্জ, কোয়ালকমের কুইকচার্জ, ইউএসবি-পিডি, স্যামসাংয়ের সুপার ফাস্ট চার্জ, শাওমির হাইপারচার্জ, অপ্পোর সুপারভুক—এগুলো সবই ফাস্ট চার্জিং স্ট্যান্ডার্ডের উদাহরণ।

এ থেকে প্রশ্ন আসতে পারে, ভোল্টেজ বাড়িয়ে যদি চার্জিংয়ের সময় কমিয়ে আনা যায়, তাহলে সব ফোনেই কেন এ রকম উচ্চ ভোল্টেজের চার্জিং প্রযুক্তি থাকে না? আর কেনই-বা ফোন কোম্পানিগুলো ১০০, ২০০, ৩০০ ভোল্টেজ ব্যবহার করে আরও দ্রুত চার্জিং সমাধান আনছে না?

দুটি প্রশ্নের উত্তর একই—ওভারহিটিং। মানে ব্যাটারি অতিরিক্ত গরম হয়ে যাওয়া। এটাই ফাস্ট চার্জিংয়ের সবচেয়ে বড় সমস্যা বা অসুবিধা।

চার্জের সময় ভোল্টেজ যত বৃদ্ধি পায়, ব্যাটারি তত বেশি গরম হতে থাকে। প্রচলিত মুঠোফোনের ব্যাটারিগুলোর জন্য এটা মোটেই ভালো নয়। কারণ, ওভারহিটিংয়ে ব্যাটারির আয়ুষ্কাল খুব দ্রুত কমে যায়, বিশেষ করে লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারিগুলোর।

বাজারে প্রচলিত মুঠোফোনের ব্যাটারিগুলোর প্রায় সবই লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি। এর একটি সীমাবদ্ধতা হচ্ছে এর নির্দিষ্টসংখ্যক

চার্জিং সাইকেল বা চার্জ চক্র। একটি ব্যাটারি একবার পুরো চার্জ দিয়ে, তার পুরোটা ব্যবহার করাকে ধরা হয় একটি চার্জ চক্র। একবারেই যে পুরো ১০০ ভাগ চার্জ দিতে হবে বা একেবারেই পুরো চার্জ ব্যবহার করতে হবে, বিষয়টা এমন নয়। একাধিকবার চার্জ দিয়ে মোট ১০০ ভাগ চার্জ দেওয়া ও একাধিকবার চার্জের পরে মোট ১০০ ভাগ চার্জের সমপরিমাণ চার্জ খরচ করলেও তা এক চার্জ চক্রের সমানই হবে। এই চার্জ চক্রের মাধ্যমে ব্যাটারির আয়ুষ্কাল হিসাব করা হয়। অর্থাৎ ওই নির্দিষ্ট সংখ্যকবার ব্যাটারিটি চার্জ দেওয়া যাবে। ওই সংখ্যার যত কাছে যাওয়া হবে, ব্যাটারির চার্জ ধারণক্ষমতা ও আয়ুষ্কাল তত কমতে থাকবে। যেহেতু ফাস্ট চার্জিংয়ের কারণে ব্যবহারকারীর চার্জ দিতে কম সময় লাগে এবং অল্প চার্জ দিয়ে বেশি সময় ফোন ব্যবহার করা যায়, তাই ব্যবহারকারী এ ক্ষেত্রে সাধারণত ফোন প্রচুর ব্যবহার করেন ও ব্যাটারি ফুরিয়ে গেলে বারবার চার্জ দিতে থাকেন। ফলে লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারিগুলো সেই চার্জিং সাইকেল সংখ্যার দিকে আরও দ্রুত এগোতে থাকে। এর সঙ্গে ফাস্ট চার্জিংয়ের ওভারহিটিং সমস্যা তো আছেই। ব্যাটারির ওপর এটি আরও চাপ ফেলতে শুরু করে।

ওভারহিটিং সমস্যা মোকাবিলা করতে ফোন কোম্পানিগুলো তাদের ব্যাটারি ইউনিটগুলোকে এখন একাধিক ভাগে ভাগ করে একই সঙ্গে একাধিক অংশে চার্জের ব্যবস্থা করছে। এতে দুই ধরনের সমস্যা হয়। এক. ব্যাটারির ভেতরে জায়গা কমে যায়, ফলে ব্যাটারির চার্জ ধারণক্ষমতা কমে যায়। আর দুই. ব্যাটারির ধনাত্মক ও ঋণাত্মক পোল বা অংশকে আলাদা রাখার জন্য মাঝখানে একটি ব্যান্ড বা বাধা থাকে। দ্রুত চার্জ করার জন্য এই বাধার পুরুত্ব কমিয়ে দেওয়া হয়। এ কারণেও ব্যাটারির চার্জ ধারণক্ষমতা বা ক্যাপাসিটি খানিকটা কমে যায়। আবার ওভারহিটিংয়ের জন্য ব্যাটারির আয়ুষ্কাল কমে যাওয়ার পাশাপাশি চার্জিংয়ের সময় তাপ আকারে অনেক শক্তি অপচয় হয়।

এসব কারণেই যথেষ্ট রিসোর্স ও গবেষণাপ্রযুক্তি থাকা সত্ত্বেও অ্যাপল এখনো তাদের ফোনকে নিজস্ব ১৫ ওয়াট চার্জার দিয়ে চার্জ দিতে ব্যবহারকারীদের উৎসাহিত করে। কারণ, তাদের বিজনেস মডেল সাবস্ক্রিপশন-বেজড। অর্থাৎ একটি ফোন ব্যবহারকারীর হাতে যত দিন থাকবে, তত দিন অ্যাপলের কাছে লাভ আসবে। তাই তারা চায়, তাদের ফোনগুলো যেন দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং এ কারণেই তাদের ফোনে ফাস্ট চার্জিং সাপোর্ট ও প্রোপ্রাইটরি ফাস্ট চার্জার থাকলেও তারা নিঃসন্দেহে রেগুলার চার্জিংয়েরই পক্ষে।

আসুসও তাদের গেমিং ফোনে ফাস্ট চার্জিং সাপোর্ট থাকা সত্ত্বেও বাইপাস চার্জিং উদ্ভাবন করেছে। এর ফলে চার্জে থাকা অবস্থায় ব্যবহার করলে ফোনটি ব্যাটারি থেকে পাওয়ার না নিয়ে সরাসরি চার্জিং কেব্‌ল থেকে পাওয়ার নিয়ে কাজ করবে। এতে ফোন চার্জে থাকা অবস্থায় ফাস্ট চার্জিংয়ের ফলে ওভারহিটিং সমস্যা থেকে সাময়িকভাবে হলেও ব্যাটারি রক্ষা করা যাবে।

তা ছাড়া আসন্ন গ্রাফিন প্রযুক্তি ও ফোনগুলোর নিজস্ব অপটিমাইজড চার্জিং প্রটোকল অবশ্যই ফাস্ট চার্জিংয়ের এই সীমাবদ্ধতাগুলো কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করবে। তার আগে ব্যাটারি ও ফোন সুরক্ষিত রাখার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো, রেগুলার বা লো–এনার্জি চার্জিং। তাই দরকার না হলে অযথা ফাস্ট চার্জিং প্রযুক্তি বা বেশি ওয়াটের (মানে বেশি ভোল্টেজের) চার্জার ব্যবহার না করাই ভালো।

লেখক: শিক্ষার্থী, গণিত বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র: হাউ ইট ওয়ার্কস